মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন
শায়খ ড. বানদার বিন আবদুল আজিজ বালিলাহ:
ইমানের অন্যতম ভিত আখেরাতের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সংঘটিত বিষয় নিয়ে আল্লাহ এবং তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যেসব সংবাদ দিয়েছেন তা সমর্পণ চিত্তে মেনে নেওয়ার নামই হলো ইমান। আল্লাহতায়ালা আনুগত্যশীল বান্দার জন্য যে প্রতিদান রেখেছেন এবং অবাধ্যদের জন্য যে শাস্তি রেখেছেন, সেসবের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিমমুখী (নামাজ) করবে। বরং পুণ্য হলো, যে আল্লাহর প্রতি এবং শেষদিনের প্রতি ইমান রাখে।’ সুরা বাকারা : ১৭৭
আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাসের মানদণ্ডে খাঁটি ও সত্যবাদী মুমিন ও অবিশ্বাসী ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। কারণ আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের সম্পর্ক মূলত গায়েবের প্রতি ইমান রাখা এবং সন্দেহ ও সংশয়কে ছুড়ে ফেলার নাম। কোরআনে কারিমের শুরুতে তাই আল্লাহ বলেন, ‘আলিফ-লাম-মিম। এটি এমন কিতাব, যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটা হেদায়েত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য, যারা অদৃশ্য বিষয়াবলিতে ইমান রাখে এবং নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদের যা কিছু দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।’ সুরা বাকারা : ১-৩
নিজ কওমের মধ্যে রাসুলদের যে দাওয়াতি নির্দেশনা ছিল, তার অন্যতম হলো কিয়ামত দিবসের প্রতি ইমান আনা এবং কিয়ামতের নানা অবস্থা ও ভয়াবহতার বিষয়ের প্রতি আহ্বান করা। কারণ আখেরাতের স্মরণ ব্যক্তির কল্যাণ ও হেদায়েতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার প্রমাণ বহন করে। কিয়ামতের ময়দানে উপনীত হওয়ার প্রথম স্তরের নাম হলো ব্যক্তির মৃত্যু। তারপর তার কবর। আর কবর! সে তো নানা পরীক্ষার স্থান। হয়তো ব্যক্তি তাতে সম্মানিত হবে নতুবা হবে লাঞ্ছিত। মুমিনরা হবে সফলকাম এবং তাদের সম্মানিত করা হবে। আর অবিশ্বাসীরা হবে অপদস্ত এবং শাস্তির সম্মুখীন।
কবর হয়তো নাজ-নেয়ামতে পূর্ণ থাকবে নতুবা আজাবে ভরা থাকবে। এরপরই হবে পুনরুত্থান এবং আখেরাত। আল্লাহ বলেন, ‘এবং এ জন্য যে, কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী। তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এ জন্য যে, যারা কবরে আছে আল্লাহ তাদের সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।’ সুরা হজ : ৭
এরপর রুহগুলোকে যার যার দেহে ফেরত দেওয়া হবে। লতাপাতা ফেটে জমিনের ভূগর্ভ থেকে বের হওয়ার ন্যায় জমিনগুলো ফেটে সবাই কবর থেকে বের হয়ে আসবে। এরূপ অবস্থার অবতারণা শেষে বড় কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। মানুষেরা তাদের কবর থেকে নগ্ন পায়ে, উলঙ্গ হয়ে এবং খতনাহীন হয়ে বের হয়ে আসবে। সূর্য তাদের নিকটবর্তী হবে। শরীরের ঘাম বেয়ে পড়বে। প্রত্যেকের আমল পরিমাপের জন্য মিজানের পাল্লা স্থাপন করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে; তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে।’ সুরা মুমিনুন : ১০২-১০৩
কিয়ামতকালে প্রত্যেকের আমলনামা প্রকাশ করা হবে। কারও আমলনামা ডান হাতে আবার কারও আমলনামা বাম হাতে বা পৃষ্ঠদেশে পেশ করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক মানুষের (কাজের) পরিণাম তার গলদেশে সেঁটে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন আমি (তার আমলনামা) লিপিবদ্ধরূপে তার সামনে বের করে দেব, যা সে উন্মুক্ত পাবে। (বলা হবে) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ সুরা ইসরা : ১৩-১৪
এরপর আল্লাহতায়ালা সমগ্র সৃষ্টির হিসাব নেবেন। তিনি তার মুমিন বান্দার সঙ্গে একাকী বসবেন এবং তার গোনাহকে স্বীকার করতে বলা হবে আর সে স্বীকার করে নেবে। আর সে আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী হবে। আর যে কাফের ও মুনাফিক হয়তো সে স্বীকার করবে। অথবা এই বিষয়ে মিথ্যা তর্কে লিপ্ত হবে। এই মিথ্যাবাদীর কান, চোখ এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকই সেই সব মিথ্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। এরপর তাদের জন্য জাহান্নামকে উন্মোচিত করা হবে। সেদিকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাতে তারা নিক্ষেপিত হবে।
এদিকে মুমিন যারা, তারা একটু বিলম্ব করবে। যাতে সম্মানিত হাওজে কাউসার থেকে তারা পান করতে পারে। নবীজির হাউজ। যে হাউজের পানি দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও সুমিষ্ট। আকাশের তারকারাজির ন্যায় অগণিত পানপাত্র হবে। যে কূপের দৈর্ঘ্য এক মাসের পথ। আর প্রস্থও তেমনি এক মাসের পথ। এ হাউজে কাউসার থেকে একবার যে পান করবে, সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।
তারপর মুমিনদের জন্য জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যকার একটি পুলসিরাত কায়েম করা হবে। প্রত্যেকে তার আমলের পরিমাপ অনুযায়ী পার হয়ে যাবে। তাদের অগ্রভাগে থাকবে নবী ও রাসুলরা। এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি ও কঠিন অবস্থায় দেখে বলবে, ‘হে আল্লাহ, আমাদের বাঁচান! হে আল্লাহ, রক্ষা করুন। এরপর তাদের জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যকার একটি পুলের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাদের কারও কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এরপর তাদের পূতঃপবিত্র করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তার (জান্নাতের) রক্ষীরা তাদের বলবে, আপনাদের প্রতি সালাম। আপনারা সুখে থাকুন। আপনারা এতে স্থায়ী অবস্থানের জন্য প্রবেশ করুন। তারা (জান্নাতবাসীরা) বলবে, সমস্ত শোকর আল্লাহর, যিনি আমাদের সঙ্গে কৃত নিজ ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন এবং আমাদের এরূপ করে এ ভূমির অধিকারী বানিয়েছেন যে, আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই ঠিকানা বানাতে পারি। প্রমাণিত হলো উৎকৃষ্ট পুরস্কার সৎকর্মশীলদের জন্য। তুমি ফেরেশতাদের দেখতে পাবে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সঙ্গে তার তাসবিহ পাঠ করছে এবং মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করে দেওয়া হবে আর বলা হবে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।’ সুরা জুমার : ৭৩-৭৫
আখেরাত দিবস এবং এর ভয়াবহতা ও নানা অবস্থার ওপর প্রকৃতরূপে বিশ্বাস স্থাপন ব্যক্তির জীবনকে সুন্দর করে, অন্তরকে পবিত্র করে। জীবনে আনে স্থিরতা ও অবিচলতা। আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং এর স্মরণের কারণে ব্যক্তি কোনো হারাম কাজে লিপ্ত হয় না। নিজের জীবনকে ধ্বংসকারী কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়নি। পরকালের অনিবার্য ও দীর্ঘস্থায়ী সুখ লাভে কোনো ধরনের শৈথিল্য করে না।
পার্থিব এই জীবন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। আর আখেরাতের আগমন অবশ্যম্ভাবী। আর মুমিনের সর্বোচ্চ প্রত্যাশার জায়গা হলো, সে কামনা করে তার আমলের পাল্লা যেন কাল কিয়ামত দিবসে ভারী হয়। ঠিক তখনই তাকে সুসংবাদ দেওয়া হবে। এরপর তার গন্তব্য হবে চিরস্থায়ী সে স্থান। যা একমাত্র মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে সে লাভ করবে।
৭ জানুয়ারি মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা।
অনুবাদ করেছেন নাজমুল হুদা